উদ্ভিদের জৈবনিক কর্মকাণ্ড তার পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পরিচালিত হয় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। → খনিজ লবণ ভৌত-রাসায়নিক এসব কর্মকাণ্ডগুলো হচ্ছে পানি ও লবণ উত্তোলন, প্রস্বেদন, নাইট্রোজেন আত্মীকরণ, সালোকসংশ্লেষণ, শ্বসন, পুষ্পায়ন প্রভৃতি। দুটি গ্রিক শব্দ Physis = nature এবং logos discourese থেকে Physiology শব্দটি এসেছে । Stephen Hales কে Plant Physiology র জনক বলা হয়।
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পরিপূর্ণ শারীরিক বিকাশের জন্য মাটি থেকে আয়ন হিসেবে খনিজ লবণ শোষণ প্রক্রিয়াই হলো লবণ পরিশোষণ (Absorption of mineral salts)।
নিচে বর্ণিত ছকের মাধ্যমে উদ্ভিদ যেসব পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে তা দেখানো হলো :
মৌলের নাম (ম্যাক্রোমৌল) | ধাতু/অধাতু | রাসায়নিক সংকেত | গ্রহণীয় রূপ | শুষ্ক ওজনের ঘনত্ব (m mol/kg) |
১. হাইড্রোজেন | অধাতু | H | H2O | 60,000 |
২. কার্বন | অধাতু | C | CO2 | 40,000 |
৩. অক্সিজেন | অধাতু | O | O2,CO2,H2 | 30,000 |
৪. নাইট্রোজেন | অধাতু | N | NO3−,NH4+ | 1000 |
৫. পটাসিয়াম | ধাতু | K | K+ | 250 |
৬. ক্যালসিয়াম | ধাতু | Ca | Ca++ | 125 |
৭. ম্যাগনেসিয়াম | ধাতু | Mg | Mg++ | 80 |
৮. ফসফরাস | অধাতু | P | PO43− | 60 |
৯. সালফার (গদ্ধক) | অধাতু | S | SO42− | 30 |
১০. ক্লোরিন | অধাতু | Cl | Cl− | 3.0 |
১১. বোরন | অধাতু | B | BO3− | 2.0 |
১২. আয়রন (লৌহ) | ধাতু | Fe | Fe2+,Fe3+ | 2.0 |
১৩. ম্যাঙ্গানিজ | অধাতু | Mn | Mn2+ | 1.0 |
১৪. জিংক (দস্তা) | অধাতু | Zn | Zn2+ | 0.3 |
১৫. কপার (তামা) | অধাতু | Cu | Cu2+ | 0.1 |
১৬. নিকেল | অধাতু | Ni | Ni2+ | 0.5 |
১৭. মলিবডেনাম | অধাতু | Mo | MO42− | 0.001 |
উদ্ভিদের খনিজ লবণ পরিশোষণ প্রক্রিয়াঃ
উদ্ভিদে খনিজ লবণ পরিশোষণের দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে পরিশোষণ।
১. সক্রিয় পরিশোষণ এবং
২. নিষ্ক্রিয় বা পরোক্ষ পরিশোষণ
মাটিস্থ দ্রবণে কোনো আয়নের ঘনত্ব মূলের শোষণ অঞ্চলের কোষরসে সেই আয়নের ঘনত্ব অপেক্ষা কম হলেও দেখা যায় মাটির দ্রবণ হতে ঐ আয়ন কোষের অভ্যস্তরে প্রবেশ করছে। ঘনত্ব আনতির (concentration gradient) বিপরীতে এই শোষণ ঘটে বলে এতে বিপাকীয় শক্তির প্রয়োজন পড়ে। বিপাকীয় কার্যাবলির কারণে শ্বসন হার বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই এ জাতীয় পরিশোষণকে সক্রিয় পরিশোষণ ( Active salt absorption) বলে। অধিকাংশ খনিজ লবণ সক্রিয় পরিশোষণ পদ্ধতিতেই মূল কর্তৃক পরিশোষিত হয়ে থাকে। সক্রিয় শোষণেরও বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে; যেমন- সাইটোক্রোম পাম্প মতবাদ, প্রোটন-অ্যানায়ন কোট্রান্সপোর্ট মতবাদ, লেসিথিন মতবাদ ইত্যাদি। তবে প্রত্যেক মতবাদই আয়ন বাহক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সক্রিয় শোষণে ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন একই সাথে পরিশোষিত হতে পারে।
আয়ন বাহক ধারণা (The carrier concept of ion) :
আয়ন বাহক ধারণার উপর নির্ভরশীল তিনটি মতবাদ নিচে বর্ণনা করা হলো :
(i) লুনডেগড় মতবাদ (Lundegardth theory 1955) : এ মতবাদকে Cytochrome pump মতবাদও বলা হয়। এ মতবাদ অনুযায়ী বাহক হচ্ছে cytochrome (Cyt.)। লুনডেগরের, মতানুযায়ী অ্যানায়ন পরিশোষণ প্রকৃতপক্ষে cytochrome system এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। লুনডেগড় এর মতে কোষঝিল্লির ভেতরের তল-এ ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে প্রোটন (H + ) এবং ইলেকট্রন (e -) সৃষ্টি হয়। ইলেকট্রনটি সাইটোক্রোম চেইন এর মাধ্যমে কোষঝিল্লির বাইরের দিকে চলে আসে এবং
0 2 এর সাথে মিলে প্রোটন চিত্র সহযোগে পানি তৈরি করে। এর ফলে কোষঝিল্লির বাইরের তলে সাইটোক্রোমের বিজারিত লৈৗহ (reduced iron) ইলেকট্রন হারিয়ে জারিত (oxidised) হয় এবং একটি অ্যানায়ন গ্রহণ করে।
কোষঝিল্লির ভেতরের তলে (inner space) সাইটোক্রোমের জারিত লৌহ ডিহাইড্রোজিনেজ বিক্রিয়া হতে প্রাপ্ত ইলেকট্রন গ্রহণ করে বিজারিত হয় এবং কোষঝিল্লির বাইরের তলে (outer space) সাইটোক্রোমের জারিত লৌহ যে অ্যানায়ন গ্রহণ করে তা বিক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে ভেতরের দিকে মুক্ত করে দেয়। এভাবে ভেতরের দিকে অ্যানায়ন জমা হতে থাকে। কিন্তু ক্যাটায়ন শোষণ নিষ্ক্রিয়ভাবে বহিঃস্থ দ্রবণ থেকে কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
(ii) প্রোটন-অ্যানায়ন কো-ট্রান্সপোর্ট মতবাদ (Proton-Anion co-transport theory): আধুনিক ধারণায় কোষঝিল্লির উভয় দিকে একটি তড়িৎ রাসায়নিক নতিমাত্রা (electrochemical gradient) সৃষ্টির মাধ্যমে আয়নগুলো কোষের ভেতরে স্থানান্তরিত হয়।
এ আধুনিক মতবাদ অনুসারে, আয়ন নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক প্রোটিন বাহক দ্বারা বাহিত হয়ে বাইরের দ্রবণ থেকে কোষের ভেতরের দ্রবণে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট প্রোটিন নির্দিষ্ট আয়নের বাহক হিসেবে কাজ করে।
ধারণা করা হয় কোষঝিল্লির ভেতরের তলের দিকে ATP-ase এনজাইমের ক্রিয়ায় ATP ভেঙ্গে শক্তি নির্গত হয়। যার প্রভাবে প্রোটন কোষের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়। একে প্রোটন পাম্প বলে। প্রোটন পাম্পের কারণে কোষের বাইরের সাথে ভেতরের দিকে pH gradient (বাইরে pH কম) এবং potential gradient (কোষের বাইরের +ve চার্জ বেশি, কোষের ভেতরে +ve চার্জ কম) তৈরি হয় যাকে একত্রে Electrochemical potential gradient বা Proton motive force বলে। কোষ পর্দার অভ্যন্তরে Proton motive force তৈরি হলেই বাহক প্রোটিনগুলো সক্রিয় হয় এবং ক্যাটায়নগুলোকে বহন করে বাইরের দ্রবণ থেকে কোষের ভেতরে নিয়ে আসে। প্রোটনও বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকতে চায়, আর সে সময় অ্যানায়নগুলো প্রোটনের সাথে (প্রোটন ও অ্যানায়ন একসঙ্গে প্রোটিন বাহকের মাধ্যমে কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এজন্য একে প্রোটন-অ্যানায়ন কো-ট্রান্সপোর্ট বলা হয়। এ ধারণাটি Peter Mitchel (1968) এর কেমি-অসমোটিক মডেলের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
(iii) লেসিথিন বাহক ধারণা (Lacithin carrier concept) : Bennet Clark (1956) নামক বিজ্ঞানী মনে করেন, লেসিথিন নামক ফসফোলিপিড আয়ন বাহক হিসেবে কাজ করে। লেসিথিন কোষঝিল্লির বাইরের তলে অ্যানায়ন ও ক্যাটায়ন গ্রহণ করে একটি যৌগ তৈরি করে ভেতরের তলে নিয়ে যায়। যৌগটি ভেতরের তলে কোলিন ফসফেটাইডিক অ্যাসিড এ ভেঙ্গে গিয়ে আয়ন দুটিকে মুক্ত করে ATP প্রয়োজনীয় শক্তি যোগান দেয়।
যে পরিশোষণ প্রক্রিয়ায় আয়ন শোষণের জন্য কোনো বিপাকীয় শক্তির প্রত্যক্ষ প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না সেই পরিশোষণই হলো নিষ্ক্রিয় পরিশোষণ (Passive Salt absorption) । এতে শ্বসন হার স্বাভাবিক থাকে। নিষ্ক্রিয় পরিশোষণ প্রক্রিয়া নিম্নলিখিত উপায়ে ঘটে থাকে :
(i) ব্যাপন মতবাদ (Diffusion Theory): মাটিতে অবস্থিত দ্রবণ হতে কোষের অভ্যন্তরে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কিছু আয়ন প্রবেশ করে। উদ্ভিদের লবণ শোষণ অঞ্চলের কোষরসে কোনো আয়নের ঘনত্ব মাটির দ্রবণে অবস্থিত ঐ আয়নের ঘনত্ব হতে কম হলে আয়নটি মাটির দ্রবণ হতে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কোষরসে প্রবেশ করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে আয়ন পরিশোষিত হতে থাকে। (Hope & Stevens, 1952)
(ii) আয়ন বিনিময় মতবাদ (lon exchange theory) : উদ্ভিদমূলের কোষরস হতে হাইড্রোজেন
(H +) আয়ন বাইরের দ্রবণে নির্গত হয়। তখন কোষের বৈদ্যুতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য বাইরের ভরণ হতে ক্যাটায়ন (K + ) কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। একইভাবে হাইড্রোক্সিল (OH −) আয়নের বিনিময়ে অ্যানায়ন (Cl − আয়ন) কোষরসে প্রবেশ করে। আয়ন এক্সচেঞ্জ বলতে আয়নের এরূপ বিনিময়কে বোঝানো হয়। ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন একসাথে পরিশোষিত হয় না। ডেভলিন (১৯৬৯), পান্ডে ও সিনহা (১৯৭২) এই মতবাদের প্রবক্তা।
(iii) ডোন্যান সাম্যাবস্থা মতবাদ (Donan equilibriam theory) : কোষঝিল্লির অভ্যন্তরে অব্যাপনযোগ্য কিছু স্থির ঋণাত্মক চার্জ থাকলে, একে নিরপেক্ষ করার জন্য বাহির হতে কিছু ধনাত্মক চার্জাবিশিষ্ট ক্যাটায়ন ঝিল্লির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। প্লাজমাঝিল্লির ভেতর এরূপ স্থির আয়নের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে বাইরে থেকে ভেতরে একটি সাম্যাবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত ক্যাটায়নের ব্যাপন চলতে থাকে একে ডোন্যান সাম্যাবস্থা বলে। বিজ্ঞানী F. G. Donnan (1911-1914) এই মতবাদের প্রবক্তা।
(iv) ব্যাপক প্রবাহ মতবাদ (Mass flow theory): অনেক বিজ্ঞানী (Hylmo (1955) ও Kramen (1956) মনে করেন যে, প্রস্বেদন টানে যখন ব্যাপক হারে পানি পরিশোষিত হয় তখন পানির সাথে সাথে খনিজ লবণের আয়নও পরিশোষিত হয়।
উদ্ভিদের সবুজ যাবতীয় অংশে বিশেষ করে কচি কান্ড ও পাতার ত্বকে পত্ররন্ধ (stomata) নামের অতি ক্ষুদ্র বস্ত থাকে। বিষমপৃষ্ঠ (dorsiventral) পাতার নিম্নত্বকে এবং সমাঙ্গপৃষ্ঠ (isobilateral) পাতার নিম্ন ও ঊর্ধ্বত্ত্বকে গ্রন্তে পাওয়া যায়। পানিতে ভাসমান পাতার উপত্তিকে পররক্তে থাকে। পত্ররন্ধের কেন্দ্রে একটি ছিদ্র বা বন্ধু থাকে একে র ছিদ্র (stomatal pore) বলে। দুটি অর্ধচন্দ্রাকার রক্ষীকোষ (guard cell) দিয়ে প্রতিটি পত্ররন্ত পরিবেস্টিত থাকে। রক্ষীকোষের মধ্যে ঘন সাইটোপ্লাজম, একটি নিউক্লিয়াস এবং ক্লোরোপ্লাস্টিড বিদ্যমান। পত্ররন্ধের নিচে থাকে একটি বড় বায়ুপূর্ণ স্থান । এটি উপ-পত্ররন্দ্রীয় গহ্বর (sub-stomatal cavity)। রক্ষীকোষের চারদিকে অবস্থিত সাধারণ ত্বকীয় কোষ থেকে একটু ভিন্ন আকার-আকৃতির সহকারি কোষ থাকে। সহকারি কোষগুলোসহ প্রতিটি পরবন্ধকে পত্ররন্ধ প্লেক্স (stomatal complex) বলা হয়। কিছু উদ্ভিদে সহকারী কোষ থাকেনা, যেমন, শশা, কুমড়া, কিছু অর্কিড। রক্ষীকোষ দুটির গঠনশৈলী একটু বিচিত্র ধরনের। অর্ধ চন্দ্রাকার এ কোষদুটির প্রাচীরের পুরুত্ব সবদিকে একরকম নয়। রক্তের দিকের প্রাচীরটি অত্যন্ত পুরু কিন্তু বিভাগের প্রাচীর পাতলা। অন্তঃঅভিস্রবণের ফলে তাঁকোষ পানি শোষণ করে স্ফীত হলে পাতা চোরের দিকের অতিরিক্ত চাপের টানে পুরু প্রাচীরটি কিছুটা বেঁকে বন্ধ উন্মুক্ত করে দেয়। উদ্ভিদের প্রজাতিভেদে পাতার ১ বর্গ সেঃ মিঃ এলাকায় রাষ্ট্রের সংখ্যা প্রায় ১০০০ থেকে ৬০০০০।
পত্ররন্ধের প্রকারভেদ (Types of foliage)
১. Diacytic : স্টোমা দুটি সাবসিডিয়ারি কোষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। কোষ দু’টি রক্ষীকোষের সাথে সমকোণে অবস্থিত।
২. Paracytic : স্টোমা দুটি সাবসিডিয়ারি কোষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। কোষ দুটি রক্ষীকোষে সমান্তরালভাবে অবস্থিত।
৩. Anisocytic : স্টোমা তিনটি সাবসিডিয়ারি কোষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, তার মধ্যে একটি কোষ ছোট।
8. Tetracytic : স্টোমা চারটি সাবসিডিয়ারি কোষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
৫. Actinocytic : স্টোমা অনেকগুলো রেডিয়েলি লম্বা কোষ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
৬. Anomocytic : স্টোমাকে পরিবেষ্টনকারী কোষসমূহ সাধারণ ত্বকীয় কোষ থেকে পৃথকযোগ্য নয়।
পত্ররন্ধ্রের কাজঃ
১. পত্ররন্ধ্র সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসন প্রক্রিয়ার সময় গ্যাস বিনিময় করে।
২. এর রক্ষাকোষ খাদ্য তৈরি করে এবং রক্তকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. প্রস্বেদনের সময় পানি জলীয় বাষ্পাকারে এর ভিতর দিয়ে নির্গত হয়।
৪. পুকাশিত পত্ররন্ধ্র প্রস্বেদনের হার হ্রাস করে।
৫. পরবন্ধে উদ্ভিদ দেহ হতে পানি ও অন্যান্য তরল পদার্থ নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে।
পত্ররন্ধের খোলা ও বন্ধ হওয়া নির্ভর করে রক্ষীকোষের পরিবর্তনের উপর অর্থাৎ রক্ষীকোষের স্ফীতি হলে পত্ররন্ধ্র খুলে যাবে এবং রক্ষীকোষ শিথিল হলে পত্ররন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাবে। পত্ররন্ধ্রের ছিদ্রের আয়তন নির্ভর করবে রক্ষীকোষ কতটা স্ফীত হয়েছে তার উপর। স্ফীতি হওয়ার ফলে রক্ষীকোষের বাইরের পাতলা প্রাচীরের দিকে অতিরিক্ত চাপের টানে ভিতরেরপুরু প্রাচীরটি কিছুটা বেঁকে যায়। ভিতরের পুরু প্রাচীরটি যেহেতু স্থিতিস্থাপক নয় প্রাচীরটি তাই, অবতল (concave) আকার হয়ে যায় ফলে পত্ররন্ধ্রটির আয়তন বাড়তে থাকে এবং পত্ররন্ধ্রটি খুলে যায়। বিজ্ঞানী স্যায়েরি (Sayre, 1926)-র মতে, শ্বেতসার ও চিনির উক্ত আন্তঃপরিবর্তনটি কোষরসের pH এর জন্য ঘটে থাকে এবং তাঁর মতে, কোষরসের pH এর উঠা-নামাই পত্ররন্ধ্রের খোলা ও বন্ধ হওয়ার জন্য দায়ী। উচ্চ pH (৭-এর কাছাকাছি) পত্ররন্ধ্র খুলতে সাহায্য করে এবং নিম্ন pH (৫-এর কাছাকাছি) পত্ররন্ধ্র বন্ধ হতে সাহায্য করে। রাত্রিকালে আলো না থাকাতে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ থাকে কিন্তু শাসন চলতে থাকে। শ্বসনের ফলে সৃষ্ট CO, রক্ষীকোষের কোষ রসে দ্রবীভূত হয়ে কার্বনিক এসিডের সৃষ্টি করায় কমে যায়।
পত্ররন্ধ্রগুলো প্রস্বেদনের অতি প্রয়োজনীয় অংশ। এগুলো দিনের বেলায় উন্মুক্ত হয়, রাতে বন্ধ থাকে। পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে যে প্রস্বেদন হয় তাকে পত্ররন্ধ্রীয় প্রস্বেদন বলে।
মাটি থেকে মূলরোম দ্বারা শোষিত বিপুল পরিমাণ পানির অতি সামান্য অংশ উদ্ভিদের বিভিন্ন জৈবনিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়, আর অধিকাংশ পত্ররন্ধ্রীয় প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাষ্পাকারে নির্গত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়। মাটি থেকে শোষিত পানি পাতার শিরা- উপশিরার মাধ্যমে প্যালিসেড ও স্পঞ্জী প্যারেনকাইমায় পৌঁছে। সেখানে সম্পৃক্ত (saturated)কোষ-সমূহের প্রাচীর থেকে পানি বাষ্পাকারে বের হয়। উক্ত বাষ্প আন্তঃকোষীয় অবকাশ এবং পত্ররন্ধ্রীয় প্রকোষ্ঠে জমা হয়। দিনের বেলায় রক্ষীকোষের রসস্ফীতির ফলে পত্ররন্ধ্র খুলে যায় এবং বাইরের বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম থাকলে আন্তঃকোষীয় অবকাশ ও পত্ররন্ধ্রীয় প্রকোষ্ঠে সঞ্চিত বাষ্প ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।
উদ্ভিদের জীবনে প্রস্বেদনের গুরুত্বঃ
প্রস্বেদন উদ্ভিদের এক স্বাভাবিক জীবন রক্ষাকারী জৈবনিক ও শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়া। এর ফলে একদিকে উদ্ভিদ যেমন উপকৃত হয় অন্যদিকে এর কিছু অপকারী ভূমিকাও রয়েছে।
উপকারী ভূমিকাঃ
১. পানি শোষণ : পাতায় প্রস্বেদনের ফলে জাইলেম বাহিকায় পানির যে টান পড়ে তা মূলরোম কর্তৃক পানি শোষণে সাহায্য করে।
২. রসের ঊর্ধ্বস্রোত : প্রস্বেদনের ফলে যে ব্যাপন চাপ ঘাটতি (DPD)-র সৃষ্টি হয় তা সরাসরি পানি বা রসকে জাইলেম বাহিকার মাধ্যমে পাতায় পৌঁছাতে সাহায্য করে অর্থাৎ রসের উর্ধ্বস্রোতে সাহায্য করে ।
৩. পাতায় অবিরাম পানি সরবরাহ : খাদ্য উৎপাদনের জন্য পাতায় অবিরাম পানি সরবরাহ ঘটায়।
৪. অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন : মূল দিয়ে শোষিত অতিরিক্ত পানি প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় নিষ্কাশিত হয় ।
৫. দৈহিক বৃদ্ধি : স্বাভাবিক প্রস্বেদন উদ্ভিদদেহের বৃদ্ধির সহায়ক
৬. পানি সংবহন : প্রস্বেদনের ফলে যে ব্যাপন চাপ ঘাটতির সৃষ্টি হয় তা পূরণে পানি শোষিত হলে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পানি সংবহিত হয়।
৭. উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ : প্রস্বেদন প্রক্রিয়া উষ্ণপ্ৰধান অঞ্চলের উদ্ভিদকে শীতল রাখে এবং সূর্যালোকে কার্যরত পাতাকে শুকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে ।
৮. সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসন : প্রস্বেদনের মাধ্যমে পত্ররন্ধ্রের যে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে তা সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসনকে প্রভাবিত করে।
৯. খাদ্য পরিবহন : প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদদেহের বিভিন্ন অংশে খাদ্য পরিবহন অব্যাহত থাকে।
১০. ছত্রাকের আক্রমণ রোধ : প্রস্বেদনের ফলে কোনো কোনো পাতার উপরতলে পানিগ্রাহী লবণ পরিত্যক্ত হয়।এ লবণ বায়ুমণ্ডল থেকে পানি গ্রহণ করে পাতাকে আর্দ্র রাখে ও ছত্রাকের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।
১১. কোষ বিভাজন : প্রস্বেদন পরোক্ষভাবে কোষের স্ফীতি বজায় রেখে কোষ বিভাজনে সাহায্য করে।
১২. অভিস্রবণ : প্রস্বেদনের ফলে কোষরসের ঘনত্ব বাড়ে, ফলে অভিস্রবণের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
১৩. শক্তি নির্গমন : পাতায় পতিত সৌরশক্তির একাংশ মাত্র (১%) বিভিন্ন কাজে ব্যায়িত হয় বাকি তাপশক্তি প্রস্বেদনের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। তা না হলে গাছ তাপিত হয়ে মারা যেত।
১৪. পুষ্প প্রস্ফুটন ও ফল সৃষ্টি : প্রস্বেদনের ফলে কোষে পরম রসস্ফীতি রক্ষা পায় বলে পুষ্প প্রস্ফুটন ও ফল সৃষ্টি সম্ভব হয়।
১৫. প্রস্বেদনের ফলে পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে গিয়ে আকাশে ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটায় । যে এলাকায় গাছপালা বেশি থাকে সে এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়।
প্রস্বেদনের অপকারিতাঃ
১. প্রস্বেদনের মাধ্যমে দেহ থেকে বাষ্পাকারে পানি বের করে দিতে উদ্ভিদের শক্তির অপচয় হয়।
২. প্রস্বেদনের কারণে উদ্ভিদের শোষিত পানির অপচয় হয়। শোষিত পানির পরিমাণ অপেক্ষা প্রস্বেদন বেশি হলে গাছ শুকিয়ে মারা যায় (উইলটিং)।
সবুজ উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে CO, ও পানি থেকে কার্বোহাইড্রেট জা প্রস্তুত করতে পারে। উদ্ভিদে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত হওয়ার এ প্রক্রিয়ার নাম সালোকসংশ্লেষণ (Photosynt গ্রিক Photo = আলো + synthesis = সংশ্লেষ)। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বার্নেস (Charles Reid Bames, 1858- Photosynthesis শব্দের প্রচলন করেন।
যে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদকোষে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলের সাহায্যে পরিবেশ চ শোষিত পানি ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সরল শর্করা (গ্লুকোজ) সংশ্লেষিত হয় এবং সৌরশক্তির আবদ্ধকরণ ঘটে তাকে সালোকসংশ্লেষণ বলে। এ প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে O2 নির্গত হয়।
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ১ অণু হেক্সোজ শর্করা প্রস্তুত করতে ৬ অণু CO ১২ অণু HO প্রয়োজন পড়ে এ ৫০-৬০ ফোটন কণা ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সালোকসংশ্লেষণকে একটি জটিল জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া বলা হয়।
আলোর উপস্থিতিতে পানি (H2O) ভেঙ্গে অক্সিজেন (O2), হাইড্রোজেন বা প্রোটন (2H) ও ইলেকট্রন উৎপন্ন হওয়াকে পানির সালোকবিভাজন (phorolysis of water) বলে।
সালোকসংশ্লেষণের অঙ্গ (Photosynthetic Organs) ক্লোরোফিলযুক্ত সকল উদ্ভিদকোষে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ও এককোষী সবুজ শৈবালের সম্পূর্ণ কোষদেহ সালোকসংশ্লেষণে অংশ গ্রহণ করে। উন্নত উদ্ভিদে। মেসোফিল টিস্যুর প্যালিসেড ও স্পঞ্জি প্যারেনকাইমা কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট অধিক সংখ্যায় থাকে। তাই এই আশে সংব সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। পাতা ছাড়া কচি কান্ড, সবুজ কান্ড, ফুলের বৃন্ত, বৃত্তি, অর্কিডের সবুজ মূল, কাঁচা সংস্থার সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। ব্যাকটেরিয়া, নীলাভ সবুজ শৈবালে কোন ক্লোরোপ্লাস্টিড থাকেনা, এদের মধ্যে chromatophore নামে সরল অঙ্গাণু থাকে যাতে রঞ্জক পদার্থ বিদ্যমান। ক্রোমাটোফোর এদের সালোকসংশ্লেন অঙ্গাণু। উন্নত উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ক্লোরোপ্লাস্ট-কে সালোকসংশ্লেষণকারী অঙ্গাণু বলা হয়। ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমা অংশে সালোকসংশ্লেষণের অন্ধকার বিক্রিয়াগুলো ঘটে এবং গ্রানা (grana)-র থাইলাকয়েড পর্দার ভিতর ক্ষুদ্র মতো অংশ- কোয়াস্টোজোম (quantosome)-এ আলোক বিক্রিয়াগুলো সংঘটিত হয়। কোয়ান্টোজোমের মধ্যে ২৫০টি ক্লোরোফিল অণু, এনজাইম ও একাধিক ইলেকট্রন বাহক এবং অন্যান্য রঞ্জক থাকে।
সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জক (Photosynthetic Pigments )
সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জকগুলো প্রধানত নিচেবর্ণিত তিন প্রকারের-
i. ক্লোরোফিল (Chlorophyll)
ক্লোরোফিল-a,ক্লোরোফিল-b
ii. ক্যারোটিনয়েড (Carotinoids)
ক্যারোটিন,জ্যান্থোফিল
iii. ফাইকোবিলিন
ফাইকোএরিথ্রিন,ফাইকোসায়ানিন
ফটোসিস্টেম : ক্লোরোফিল অণুসমূহ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রন গ্রহীতাগুলো এক সাথে একটি ইউনিট হিসেবে অবস্থান করে। এই ইউনিটকে ফটোসিস্টেম বলে। ফটোসিস্টেম থাইলাকয়েড ঝিল্লিতে অবস্থান করে এবং এতে ৪০০ পর্যন্ত ক্লোরোফিল অণু থাকতে পারে।
১. ফটোসিস্টেম-1 (PS-I) : এতে ch'a' ৬৮৩, ক্যারোটিন, জ্যান্থোফিল এবং P700 নামক একটি বিআরিত পিগমেন্ট (reactive pigment = এক বিশেষ ধরনের ক্লোরোফিল-এ) থাকে যা ৭০০ nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশি সর্বাধিক শোষণ করে, তাই একে বলা হয় P700 PS-I ক্লোরোপ্লাস্টের গ্রানা ল্যামেলীর বাইরের দিকে অবস্থিত এবং NADPH গঠনে সাহায্য করে।
২. ফটোসিস্টেম-II (PS-II) ; এতে ch'a' ৬৭৩, ch'b' এবং P680 নামক রিঅ্যাক্টিভ পিগমেন্ট (এটিও বিশেষ ধরনের ক্লোরোফিল-এ) থাকে যা ৬৮০nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল আলোকরশ্মি সর্বাধিক শোষণ করে, তাই একে বলা হয় P680. PS-II ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতরে স্ট্রোমার দিকে অবস্থিত এবং NADPH গঠনে সাহায্য করে। উপরোক্ত দুটি ফটোসিস্টেম ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন দিয়ে যুক্ত থাকে।
থাইলাকয়েড ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বা TETS এর মধ্যে নিম্নোক্ত বাহক উপস্থিত থাকে। এদের পর্যায়ক্রম হচ্ছে : -
১. ফিয়োফাইটিন (Pheophytin, Ph) : একটি রূপান্তরিত ক্লোরোফিল অণু। পরবর্তী বাহক প্লাস্টোকুইনোনের এটি সংযোগ সৃষ্টি করে।
২. প্লাস্টোকুইনোন (Plastoquinone. PQ) : লিপিড জাতীয় উপাদান যা প্রথম ইলেক্ট্রন বাহক হিসেবে সক্রিয় থেকে সাইটোক্রোমের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করে।
৩. সাইটোক্রোম (Cytochrome, Cyt): লৌহযুক্ত প্রোটিন যার লৌহ অণুটি ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে। এখানে সাইটোক্রোমটি bgf প্রকৃতির এক যৌগ (Cytbgf)। সাইটোক্রোম পরবর্তীতে গৃহীত ইলেকট্রনটিকে হস্তান্তরের জন প্লাস্টোসায়ানিনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করে।
৪. প্লাস্টোসায়ানিন (Plastocyanin, PC) : এক ধরনের প্রোটিন; এর মধ্যে রয়েছে একটি কপার অণু যা ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং ফেরিডক্সিনের কাছে হস্তান্তর করে।
৫. ফেরিডক্সিন (Ferredoxin, Fd) লোহা ও সালফার অণুযুক্ত প্রোটিন যার লোহা ইলেক্ট্রন গ্রহণ ও স্থানান্তর করে।
৬. NADP রিডাক্টেজ (NADP-reductase) : এটি এক ধরনের ফ্লাভোপ্রোটিন যা এক প্রকার সংযুক্ত কো- এনজাইম FAD (ফ্লাভিন অ্যাডিনিন ডাইনিউক্লিওটাইড) এর ফ্লাভিন গ্রুপ ইলেকট্রন গ্রহীতা।
১৯০৫ সালে ইংরেজ শরীরতত্ত্ববিদ ব্ল্যাকম্যান সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন। সালোকসংশ্লেষণের পর্যায় দুটি হলো, আলোক পর্যায় (Light dependent phase) এবং অন্ধকার পর্যায় (Light independent phase)।
আলোকনির্ভর পর্যায়
সালোকসংশ্লেষণের আলোকনির্ভর পর্যায়ের জন্য আলো অপরিহার্য। এ পর্যায়ে সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় ATP (অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট), NADPH (বিজরিত নিকোটিনামাইড অ্যাডনিন ডাইনিউক্লিওটাইড ফসফেট) এবং H+ (হাইড্রোজেন আয়ন বা প্রোটন) উৎপন্ন হয়। এই রুপান্তরিত শক্তি ATP- এর মধ্যে সঞ্চিত হয়। এই বিক্রিয়ায় ক্লোরোফিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্লোরোফিল অণু আলোকরশ্মির ফোটন শোষণ করে এবং শোষণকৃত ফোটন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ADP (অ্যাডিনোসিন ডাইফসফেট) অজৈব ফসফেটের সাথে মিলিত হয়ে ATP তৈরি করে। ATP তৈরির এই প্রক্রিয়াকে ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
সূর্যালোক এবং ক্লোরোফিলের সাহায্যে পানি বিয়োজিত হয়ে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ও ইলেকট্রন উৎপন্ন হয়। এ প্রক্রিয়াকে পানির ফটোলাইসিস বলা হয়।
আরনন (Arnon) ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ফটোফসফোরাইলেশন সম্বন্ধে ধারণা দেন। সালোকসংশ্লেষণের সময় দুধরনের ফটোফসফোরাইলেশন পরিলক্ষিত হয় । যথা : অচক্রীয় এবং চক্রীয় ।
ক. অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন (Noncyclic Photophosphorylation)
যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় ক্লোরোফিল অণু থেকে উৎক্ষিপ্ত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার পর NADP-এর সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু ইলেকট্রন যে ক্লোরোফিল থেকে নির্গত হয়েছিল সেই ক্লোরোফিলে পুনরায় ফিরে যায় না তাকে অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলা হয়।
খ. চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন (Cyclic Photophosphorylation) যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় আলোকশক্তি শোষণের ফলে উদ্দীপ্ত ক্লোরোফিল অণু থেকে নির্গত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে নিস্তেজ অবস্থায় পুনরায় ঐ ক্লোরোফিল অণুতে ফিরে আসে এবং একবার পরিভ্রমণ শেষে একটি ATP অণু তৈরি করে, তাকে চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
আলোক নিরপেক্ষ বা অন্ধকার পর্যায়
সালোকসংশ্লেষণের আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়ে আলোর প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পড়ে না। তবে আলোর উপস্থিতিতেও এই প্রক্রিয়া চলতে পারে। বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড পত্ররন্ধ্রের মধ্য দিয়ে কোষে প্রবেশ করে। আলোক পর্যায়ে তৈরি ATP, NADPH এবং H+ এর সাহায্যে আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বিজরিত হয়ে কার্বোহাইড্রেটে পরিণত হয়। সবুজ উদ্ভিদে কার্বন ডাই-অক্সাইড বিজারণের তিনটি গতিপথ শনাক্ত করা হয়েছে। যথা- ক্যালভিন চক্র, হ্যাচ ও স্ল্যাক চক্র এবং ক্রেসুলেসিয়ান এসিড বিপাক।
অন্ধকার পর্যায়ে
অচক্রিয় অন্ধকার পর্যায়ে
চক্রিয় আলোক পর্যায়ে
কোনটিই সঠিক নয়
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেলভিন ক্যালভিন (Melvin Calvin, 1911–1997) তাঁর দুজন সহকর্মী জে. ব্যাশাম ও এন্ড্রু বেনসনের সহযোগিতায় তেজস্ক্রিয় CO2 ব্যবহার করে সন্ধানী পদ্ধতিতে (tracer technique) ১৯৪৭-১৯৪৯ সালে Chlorella নামক এককোষী শৈবালে কার্বন বিজারণের চক্রাকার গতিপথ আবিষ্কার করেন। এজন্য এ পথটি ক্যালভিন চক্র নামে পরিচিত (১৯৬১ সালে সালোকসংশ্লেষণের উপর বিশেষ অবদানের জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। আবার এ পথের প্রথম স্থায়ী জৈব পদার্থ তিন কার্বনবিশিষ্ট ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিড। এজন্য এ পথটি C -চক্র নামেও পরিচিত) যে সমস্ত উদ্ভিদে C♭-চক্রের মাধ্যমে CO, এর বিজারণ হয় সেগুলো C,-উদ্ভিদ নামে অভিহিত হয়।
ক্যালভিন চক্রের বিক্রিয়াগুলো নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করা যায়।
১. বায়ু থেকে CO2 পাতার পত্ররন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে কোষে এবং পরে ক্লোরোপ্লাস্টে যায়। সেখানে ৫- কার্বনবিশিষ্ট ও দুটি ৩-ফসফেটযুক্ত রাইবুলোজ - ১.৫-বিসফসফেটের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রথমে ৬-কার্বনবিশিষ্ট বিটা-কিটো এসিড (B-Keto acid) নামক মধ্যবর্তী ও অস্থায়ী পদার্থের সৃষ্টি করে। এটি সৃষ্টি করার জন্য রাইবুলোজ বিসফসফেট কার্বক্সিলেজ অক্সিজিনেজ (Ribulose bis-phosphate Carboxylase Oxygenase, rubisco) নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম অংশ গ্রহণ করে (পৃথিবীতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম হলো rubisco কারণ এটি প্রাকৃতিক – জগত এবং জীবজগতের মধ্যে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে)। অস্থায়ী কিটো এসিড এক অণু পানির সাহায্যে দুটি
৩-কার্বনবিশিষ্ট । ৩-ফসফোগ্নিসারিক এসিড তেনা উৎপন্ন করে যা CO, বিজারণের প্রথম স্থায়ী পদার্থ এখানে প্রকৃতপক্ষে ৬ অণু CO, ও ৬ অণু রাইবুলোজ বিসফসফেট অংশগ্রহণ করে ৬-অণু বিটা-কিটো এসিড ও পরে ১২ অণু ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিড তৈরি করে।
২. ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিডের (3PGA) সঙ্গে ATP বিক্রিয়ার ফলে ফসফোরাইলেশন ঘটে ১,৩- বিসফসফোগ্লিসারিক এসিড (BPGA) উৎপন্ন হয়। এখানে ATP শক্তি খরচ করে। এ বিক্রিয়ায় ফসফোগ্লিসারোকাইনেজ নামক এনজাইমের প্রয়োজন হয় এবং ATP শক্তি যোগায় ফলে ১ অণু ADP মুক্ত হয়।
৩. ১,৩-বিসফসফোগ্লিসারিক এসিড এখন NADPH + H+ দ্বারা বিজারিত হয়ে ৩-ফসফোগ্লিসারালডিহাইড (3PGAL) অণুতে পরিণত হয়। এ সময় ৩-ফসফোগ্লিসার্যালডিহাইড ডিহাইড্রোজিনেজ নামক এনজাইম বিক্রিয়া ঘটায়। আলোক অধ্যায়ে উৎপন্ন NADPH + H+-এ বিক্রিয়ায় শক্তি যোগায় এবং NADP হিসেবে মুক্ত হয়।
৪. এক অণু ৩ - PGAL ট্রায়োজ ফসফেট আইসোমারেজ এনজাইমের সহায়তায় এক অণু DHAP-এ পরিণত হয়।3-PGAL ও DHAP পরস্পর যুক্ত হয়ে ফ্রুক্টোজ-১, ৬-বিসফসফেট উৎপন্ন করে। এটি সালোকসংশ্লেষণের ফলে উৎপন্ন প্রথম ৬C যুক্ত শর্করা।
৫. ফ্রুক্টোজ-১, ৬-বিসফসফেট যৌগটি ফ্রুক্টোজ-১, ৬- বিসফসফাটেজ এনজাইমের সহায়তায় এক অণু ফসফেট মুক্ত করে ফ্রুক্টোজ-৬ ফসফেটে পরিণত হয়।
৬. ফ্রুক্টোজ-৬--ফসফেট এক অণু ৩ ফসফোগ্লিসারালডিহাইডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি ৪C যুক্ত শর্করা এরিথ্রোজ -৪- ফসফেট ও একটি পাঁচ কার্বনযুক্ত শর্করা জাইলুলোজ -৫ -ফসফেট গঠন করে।
৭. এরিথ্রোজ-৪-ফসফেট যৌগটি ডাই-হাইড্রক্সি অ্যাসিটোন ফসফেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেডোহেপ্টুলোজ-১,৭- বিসফসফেট নামক ৭C যুক্ত শর্করা গঠন করে।
৮. সেডোহেপ্টুলোজ-১, ৭-বিসফসফেট পরবর্তী পর্যায়ে আর্দ্র বিশ্লেষিত হয়ে সেডোহেপ্টুলোজ-৭- ফসফেটে পরিণত হয়।
৯. সেডোহেপ্টুলোজ-৭-ফসফেট ট্রান্সকিটোলেজ এনজাইমের সহায়তায় আবার এক অণু PGAL এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক অণু রাইবোজ ৫- ফসফেট ও এক অণু জাইলুলোজ-৫-ফসফেট গঠন করে ।
১০. রাইবোজ-৫-ফসফেট আইসোমারেজ এনজাইমের মাধ্যমে রাইবুলোজ -৫ -ফসফেটে পরিণত হয় এবং জাইলুলোজ- ৫-ফসফেট যৌগটিও এপিমারেজ এনজাইমের সাহায্যে রাইবুলোজ -৫ -ফসফেটে পরিণত হয়।
১১. ক্যালভিন চক্রের শেষ পর্যায়ে রাইবুলোজ ৫- ফসফেট যৌগ ফসফোরাইবুলোজ কাইনেজ এনজাইমের সাহায্যে ATP যৌগের সঙ্গে বিক্রিয়া করে রাইবুলোজ-১, ৫- বিসফসফেট (RuBP) গঠন করে। এই রাইবুলোজ-১.৫- বিসফসফেট পুনরায় CO গ্রহণ করে এই চক্র চালু রাখে।
নগ্নবীজী উদ্ভিদ, টেরিডোফাইটস, ব্রায়োফাইটস এবং শৈবালের যত উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তাদের সবগুলোতেই C চক্র পাওয়া গেছে। অধিকাংশ গুপ্তবীজী উদ্ভিদে, বিশেষ করে দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে C3; চক্র বর্তমান। বেশ কিছু একবীজপত্রী উদ্ভিদেও C3, চক্র দেখা দেখা যায়। ১১টি গণের সপুষ্পক উদ্ভিদে C4 এবং C3 উভয় চক্ৰই পাওয়া গেছে (Salisbury, 1986)।
C3 উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
১. C3 উদ্ভিদের স্টোমাটা দিনে খোলা থাকে এবং রাতে বন্ধ থাকে।
২. C3 উদ্ভিদের পাতায় বান্ডলসীথ ঘিরে মেসোফিল কোষের কোন পৃথক স্তর থাকে না অর্থাৎ ক্র্যাঞ্জ অ্যানাটমি অনুপস্থিত
৩. ক্লোরোপ্লাস্টে একই রকম গ্রানাম থাকে।
৪. C3 উদ্ভিদ প্রধানত মেসোফাইটিক (যেসব উদ্ভিদ স্বাভাবিক ও পরিমিত পানি সরবরাহ আছে এরূপ স্থানে বাস করে)।
৫. এ সকল উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের জন্য সুবিধাজনক তাপমাত্রা ১০ - ২৫° সে.।
৬. বাতাসে ২০% এর বেশি O, থাকলে এদের কার্বন বিজারণ বাধাগ্রস্ত হয়। বাতাসে ৫০ – ১৫০ ppm (parts per million) CO2 এর উপস্থিতিতে C, চক্র ভালো চলে।
৮. এদের শর্করা উৎপাদন ক্ষমতা প্রজাতিভেদে নিম্ন থেকে উচ্চ
৯. এ সকল উদ্ভিদে ক্যালভিন চক্রের (C) মাধ্যমে দিনের বেলা CO, আত্তীকরণ ঘটে।
১০. উদ্ভিদে রাইবুলোজ-১, ৫-বিসফসফেট প্রথমে CO, গ্রহণ করে)
১১. এ উদ্ভিদে ক্যালভিন চক্রের প্রথম স্থায়ী যৌগ হচ্ছে ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিড।
যে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রথম উৎপন্ন স্থায়ী যৌগ ৪-কার্বনবিশিষ্ট অক্সালো অ্যাসিটিক এসিড উৎপন্ন হয় তাকে C4 সালোকসংশ্লেষণ বা C4-চক্র বলে।
বিজ্ঞানী হুগো কর্টসচক, হ্যার্ট এবং জর্জ বার ১৯৬৫ সালে প্রথম দেখান যে, আখ গাছের পাতায় সালোকসংশ্লেষণের ফলে প্রথম উৎপন্ন স্থায়ী যৌগ অক্সালো অ্যাসিটিক এসিড (OAA) ফসফোগ্লিসারিক এসিড নয়। পরে অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী এম.ডি. হ্যাচ ও সি.আর.স্ল্যাক ১৯৭০ সালে আখ ভুট্টা, (আপাং প্রভৃতি গাছে সালোকসংশ্লেষণের একটি বিশেষচক্র (cycle) আবিষ্কার করেন, যেখানে অক্সালো অ্যাসিটিক এসিডের মাধ্যমে কার্বন আত্তীকরণ প্রক্রিয়াটি ঘটে। তাঁদের নাম অনুসারে এই চক্রটিকে হ্যাচ এন্ড ব্ল্যাক চক্র বলা হয়। যেসব উদ্ভিদে এ ধরনের চক্র দেখা যায় তাদেরকে C4 উদ্ভিদ বলে । এ পর্যন্ত ৩টি একবীজপত্রী এবং ১৬টি দ্বিবীজপত্রী গোত্রে C4-চক্র দেখা যায়। তবে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে কোন উদ্ভিদেই শুধু C3-চক্রের মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষণ ঘটেনা। এদের পাতায় C3-চক্রও পাশাপাশি কার্যকর থাকে।
পাতার মেসোফিল কোষ এবং বান্ডলসীথ কোষ সম্মিলিতভাবে এই গতিপথ সম্পন্ন করে । হ্যাচ এন্ড স্ল্যাক চক্রে দুটি পর্যায়ে কার্বোক্সিলেশন বিক্রিয়া ঘটে। একটি ঘটে মেসোফিল কোষের ক্লোরোপ্লাস্টে এবং অপরটি ঘটে বান্ডলসীথের ক্লোরোপ্লাস্টে ।
হ্যাচ এন্ড স্ল্যাক চক্রটি নিম্নলিখিত কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়:
(i). বায়ুমন্ডলের CO2 প্রথমে ফসফোইনল পাইরুভিক এসিড (PEP)-এর সাথে যুক্ত হয়ে ৪-কার্বনবিশিষ্ট অক্সালো অ্যাসিটিক এসিড (OAA) উৎপন্ন করে। বিক্রিয়াটি PEP কার্বক্সিলেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ঘটে।
PEP + CO2 + H2O (PEP কার্বক্সিলেজ)→ OAA
(ii). OAA পরবর্তীতে ম্যালিক এসিড বা অ্যাসপারটিক এসিডে পরিণত হয়। উপরের বিক্রিয়াগুলো পাতার মেসোফিল টিস্যুতে ঘটে।
OAA + NADPH + H+ • ম্যালিক ডিহাইড্রোজিনেজ
→ম্যালিক এসিড + NADP+
অথবা,
OAA + NH3 + NADPH + H+(অক্সালো অ্যাসিটিক ডিহাইড্রোজিনেজ)→অ্যাসপারটিক এসিড + H2O
(iii). মেসোফিল টিস্যুতে সৃষ্ট ম্যালিক এসিড বান্ডলসীথ কোষের ক্লোরোপ্লাস্টে প্রবেশ করে এবং ডিকার্বক্সিলেজ এনজাইমের (ডিকার্বক্সিলেশন বিক্রিয়া) উপস্থিতিতে পাইরুভিক এসিড ও CO2 উৎপন্ন করে ।
ম্যালিক এসিড (ডিকার্বক্সিলেজ) → পাইরুভিক এসিড + CO2
(iv) এভাবে উৎপন্ন CO2 রাইবুলোজ বিসফসফেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যালভিন চক্রে প্রবেশ করে এবং সালোকসংশ্লেষণে শর্করা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
(v). পাইরুভিক এসিড বান্ডলসীথ কোষ থেকে মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে আসে এবং পুনরায় PEP প্রস্তুত করে।
পাইরুভিক এসিড+ ATP+Pi ((পাইরুডেট ফসফোকাইনেজ) Mg++) → PEP + AMP + PPi (পাইরোফসফেট)
উদ্ভিদ এবং এদের বৈশিষ্ট্য
গুপ্তবীজী উদ্ভিদের ১৯টি গোত্রের ৯০০ প্রজাতিরও অধিক উদ্ভিদে C4, চক্র বিদ্যমান (Salishburi, 1996)। Poaceae গোত্রের অনেক উদ্ভিদ এবং Cyperaceae গোত্রের বেশ কিছু উদ্ভিদে C4 চক্র লক্ষ করা যায়। যেমন- ধান গম, ওট, বার্লি, আখ, জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি। তিন শতাধিক দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে C4 চক্র বর্তমান বলে জানা গেছে। অধিকাংশ C4, উদ্ভিদ একবীজপত্রী ঘাস এবং নলখাগড়া জাতীয় (Sedges)।
নিচে C4 উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. C. উদ্ভিদ প্রচুর আলোতে এবং ৩০ - ৪৫° সে. তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে বেশি জন্মে। প্রধাণত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের একবীজপত্রী উদ্ভিদ এবং বেশ কিছু দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদেও এ চক্র দেখা যায় ।
২. এরা উচ্চতাপমাত্রায় সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে।
৩. এরা পানির অপচয় কম করে এবং শুষ্ক অঞ্চলেও অভিযোজিত হতে পারে।
৪. এদের মেসোফিলে বেশ দূর পর্যন্ত উন্মুক্ত বায়ুকুঠুরী থাকে যাতে এ টিস্যু সহজেই অধিক পরিমাণে CO, শোষণ ও আত্তীকরণ করতে পারে।
৫ পাতার পরিবহন টিস্যুর চতুর্দিক ঘিরে সুগঠিত বাণ্ডলসীথ অবস্থান করে। বাণ্ডলসীথের চারদিকে ঘিরে মোসোফিল কোষের এক বা একাধিক স্তর থাকতে পারে। এরূপ অন্তর্গঠনকে ক্রাঞ্জ অ্যানাটমি (Kranz Anatomy) বলে।
৬. বাণ্ডলসীথ কোষ ও মেসোফিল কোষে অনেক প্লাজমোডেজমাটা থাকে।
৭. এদের ক্লোরোপ্লাস্ট দুই রকমের (dimiorphic)। মেসোফিল ক্লোরোপ্লাস্টে গ্রানাম থাকে কিন্তু বাণ্ডলসীথ ক্লোরোপ্লাস্টে সাধারণত গ্রানাম থাকে না।
৮. বাণ্ডলসীথ ক্লোরোপ্লাস্টে প্রচুর স্টার্চ দানা থাকে, কিন্তু মেসোফিল ক্লোরোপ্লাস্টে সাধারণত স্টার্চ দানা থাকে না।
৯. এ চক্রে rubisco এনজাইম মেসোফিলে থাকে না, বাণ্ডলসীথে অবস্থান করে।
১০. উদ্ভিদে আলোকশ্বসন (photorespiration) প্রায় অনুপস্থিত এবং সহজে শনাক্ত করা যায় না। তাই সালোকসংশ্লেষণে উৎপাদিত শর্করার অপচয় কম হয়।
C4 চক্রের গুরুত্ব
১. C4 উদ্ভিদে অধিক তাপমাত্রায় (30° – 45°) সালোকসংশ্লেষণ সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু C3 উদ্ভিদে কম তাপমাত্রায় (১০°-২৫°C) CO2 বিজারণ ঘটে।
২. C4 উদ্ভিদের CO2 গ্রাহক ফসফোইনল পাইরুভিক অ্যাসিড C3উদ্ভিদের CO2 গ্রাহক রাইবুলোজ ১.৫ বিসফসফেট অপেক্ষা অধিক কার্যকর।
৩. মরু উদ্ভিদে পত্ররন্ধ্র আংশিকভাবে বন্ধ থাকলেও C4 গতিপথ চলতে পারে।
8. CO2 এর অত্যন্ত কম ঘনত্বে C4 গতিপথ চলতে পারে।
৫. C4 উদ্ভিদে ফটোরেসপিরেশন ও প্রস্বেদন কম হয় বলে CO2 বিজারণ বেশি হয়
৬. C4 উদ্ভিদের পাতায় ক্র্যাঞ্জ অ্যানাটমি-র জন্য এর খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা বেশি ও অতি সহজে এটি পরিবাহিত হতে পারে।
যদি একটি শারীরবিজ্ঞানিক প্রক্রিয়া একাধিক ফ্যাক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তবে (সর্বনিম্ন ধীর গতিসম্পন্ন ফ্যাক্টর) দ্বারাই শারীরবিজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রিত হবে যাকে লিমিটিং ফ্যাক্টর বলে।
বিভিন্ন পরিবেশ মূলক ফ্যাক্টর, যথাঃ কার্বন-ডাই-অক্সাইড, আলো, তাপ, পানি, অক্সিজেন ইত্যাদি একত্রে সালোকসংশ্লেষণের হার প্রভাবিত করে। উপরোক্ত ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে কোন একটি নির্দিষ্ট ফ্যাক্টর সালোকসংশ্লেষণ এর উপর প্রভাব বিস্তার করে তা এককভাবে অন্যান্য ফ্যাক্টর থেকে পৃথক করা কঠিন কাজ। এতদ্বসত্ত্বেও সালোকসংশ্লেষণের উপর প্রভাব সম্পন্ন প্রতিটি ফ্যাক্টরের সর্বনিম্ন, উপযুক্ত এবং সর্বোচ্চ প্রভাব কি তার উপর ব্যাপক গবেষণা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে "ল অব মিনিমাম" প্রস্তাব করেন।
১৯০৫ সালে ব্ল্যাকম্যান "ল অফ মিনিমাম" এর উপর ভিত্তি করে "ল অব লিমিটিং ফ্যাক্টর সুত্র" বা "সীমাবদ্ধতা ফ্যাক্টর সুত্র" প্রস্তাব করেন। এ সুত্র অনুযায়ী যখন কোন শারীরবিজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার দ্রুততা কয়েকটি পৃথক ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হয় সেক্ষেত্রে নিম্নতম গতিসম্পন্ন ফ্যাক্টর দ্বারাই এ প্রক্রিয়ার গতি সীমাবদ্ধ হবে।
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রা, আলোর তীব্রতা এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড এর ঘনত্ব এই তিনটি লিমিটিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। লিমিটিং ফ্যাক্টরের নীতি অনুযায়ী সালোকসংশ্লেষণ যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ে শুধুমাত্র একটি ফ্যাক্টর দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়। সালোকসংশ্লেষণের হার ওই নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরের সমানুপাতিক অর্থাৎ ফ্যাক্টরটির পরিমাণ বাড়লে সালোকসংশ্লেষণ হারও বাড়বে। কিন্তু এই ফ্যাক্টরটির পরিমাণ অপটিমাম মান থেকে অনেক বেশি হলে সালোকসংশ্লেষণের হাতের উপর এর প্রভাব হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় এবং এর স্থলে অন্য একটি ফ্যাক্টর সালোকসংশ্লেষণের হারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
শ্বসন একধরনের জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া। শ্বসনিক উপাদান নির্দিষ্ট পথে পর্যায়ক্রমে রূপান্তরিত হয়। প্রতিটি ধাপ স্বতন্ত্র এনজাইমে নিয়ন্ত্রিত। পর্যায়ক্রমিক ধাপ অতিক্রমকালে প্রাথমিকভাবে কিছু শক্তি ব্যবহৃত হয়; কিন্তু পরবর্তীতে জারণ-বিজারণ পথে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন কিছু রাসায়নিক উপাদান অর্থাৎ ATP-এর সৃষ্টি হয়। এই ATP-ই তখন জীবের সবধরনের শারীরবৃত্তীয় কাজের শক্তি যোগায়। সুতরাং শ্বসন হচ্ছে শক্তি সঞ্চারণকারী একটি শক্তিশালী জারণ- বিজারণকারী বিক্রিয়ার সমষ্টি মাত্র।
যে জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় O2-এর উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে কোষের জৈব খাদ্য জারণের মাধ্যমে শক্তি নির্গত করে এবং উপজাত দ্রব্য হিসেবে CO2 ও H2O উৎপন্ন করে তাকে শ্বসন বলে। শ্বসনের সমীকরণটি নিম্নরূপ-
C6H12O6 + 602 + 6H2O → 6CO2 + 12H2O 38 ATP (শক্তি)
শ্বসনস্থল : জীবদেহের প্রতিটি কোষেই দিনরাত্রি ২৪ ঘন্টা শ্বসন সংঘটিত হয়। প্রয়োজনীয় এনজাইম থাকায় কোষের সাইটোপ্লাজমে শ্বসনের প্রাথমিক পর্যায় সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় পর্যায় বা শক্তি উৎপাদন পর্যায় কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াতে সংঘটিত হয়। শ্বসন প্রক্রিয়ায় যে সব বস্তু জারিত হয়ে CO, ও শক্তি উৎপাদন করে সে সব বস্তুকে শ্বসনিক বস্তু বলে প্রধানত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য শ্বসনিক বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে অনেক সময় আমিষ, চর্বি ও বিভিন্ন জৈব এসিড শ্বসনিক বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
শ্বসনের প্রকারভেদ : শ্বসন প্রক্রিয়া অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে সংঘটিত হয়। অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদে দুধরনের শ্বসন সংঘটিত হয়, যেমন-
ক. সবাত শ্বসন : এ শ্বসনে মুক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় এবং বেশি পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়।
খ. অবাত শ্বসন : এ শ্বসনে যুক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না এবং অল্প পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়।
যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় মুক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় এবং শ্বসনিক বস্তু সম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে CO2, H2O ও বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে তাকে সবাত শ্বসন বলে
সবাত শ্বসনের রাসায়নিক সমীকরণ নিম্নরূপ:
C6H12O6+602 + 6H2O + 38 ADP+ 38 Pi+বিভিন্ন এনজাইম → 6CO2 + 12H, O + 38 ATP
সবাত শ্বসনের সমগ্র পদ্ধতি নিচে উল্লিখিত ৪টি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। কোষস্থিত প্রধান শ্বসনিক বস্তু গ্লুকোজ বিভিন্ন এনজাইম বিক্রিয়া দ্বারা উক্ত পর্যায়গুলোর মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে CO2, H2O ও শক্তি উৎপন্ন করে । পর্যায়গুলো নিচে উল্লেখ করা হলো ।
১. গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) : শ্বসনের প্রথম পর্যায়ে গ্লুকোজ কোষের সাইটোপ্লাজমে আংশিক জারিত হয়ে। পাইরুভিক এসিডে পরিণত হয়।
২. পাইরুভিক এসিডের জারণ (Oxidation of pyruvic acid) : পাইরুভিক এসিড মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে (মাতৃকা) প্রবেশ করার পর জারিত হয়ে ২- কার্বনযুক্ত অ্যাসিটাইল Co-A উৎপন্ন করে। এ বিক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইডের অপসারণ ঘটে বলে একে ডিকার্বক্সিলেশন বিক্রিয়াও বলা হয়।
৩. ক্রেবস চক্র (Krebs cycle) : মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে অ্যাসিটাইল Co-A বিভিন্ন এনজাইম বিক্রিয়ায় বহু জৈব এসিড উৎপাদনের মাধ্যমে চক্রাকার পথে জারিত হয়ে CO2, H2O ও বিজারিত কো-এনজাইম (সহ-উৎসেচক) NADH2, FADH, উৎপন্ন করে।
৪. ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (Electron Transport System) বা অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন(Oxidative Phosphorylation) : ক্রেবস চক্রের পর্যায়গুলো থেকে উদ্ভূত বিজারিত NAD+ ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে পরিশেষে অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পানি উৎপন্ন করে। ইলেকট্রম স্থানান্তরের সময় নির্গত শক্তি ADP ও Pi (অজৈব ফসফেট)-কে যুক্ত করে ATP অণু সৃষ্টিতে সাহায্যে করে।
যে পর্যায়ক্রমিক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এক অণু গ্লুকোজ বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতার ভেঙ্গে দুই অণু পাইরুভিক এসিডে পরিণত হয় তাকে গ্লাইকোলাইসিস (glyco = sugar + lysis = splitting) বলে। জার্মান বিজ্ঞানী Gustave George Embden (1874-1933), Otto Meyerhof (1884-1951) ও Jakob Karol Parnas (1884 1949) কর্তৃক গ্লাইকোলাইসিসের বিক্রিয়াগুলো (১৯১৪-১৯২৪ সালে) আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে তাদের নামানুসারে গ্লাইকোলাইসিসকে সংক্ষেপে EMP পথও বলা হয়। এসব বিক্রিয়ার জন্য মুক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না। তবে অক্সিজেনের উপস্থিতি এ প্রক্রিয়া সংঘটনের কোন বাধা সৃষ্টি করে না। শ্বসনিক বস্তু গ্লুকোজ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে। তবে শ্বসনিক বস্তু যাই হোক না কেন গ্লাইকোলাইসিসের পূর্বে সেসব বস্তুকে অবশ্যই গ্লুকোজে রূপান্তরিত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, গ্লুকোজ থেকে গ্লাইকোলাইসিস আরম্ভ হয় এবং পাইরুভিক এসিড তৈরি করেই এর সমাপ্তি ঘটে। গ্লাইকোলাইসিস সবাত ও অবাত শ্বসনের প্রথম ধাপ কারণ এ প্রক্রিয়ায় O2-এর প্রয়োজন হয় না। বিক্রিয়াগুলো কোষের সাইটোপ্লাজমে অক্সিজেনের উপস্থিতি অথবা অণুপস্থিতিতে ঘটে থাকে। গ্লাইকোলাইসিসের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে নিম্নরূপ :
(i) গ্লুকোজ অণু প্রথমে, ATP থেকে একটি ফসফেট গ্রহণ করে গ্লুকোজ-৬-ফসফেটযৌগ ও ADP প্রস্তুত করে । এ বিক্রিয়ায় হেক্সোকাইনেজ এনজাইম ক্রিয়াশীল হয়। বিক্রিয়াটি একমুখী ।
গ্লুকোজ + ATP → গ্লুকোজ-৬-ফসফেট + ADP
(ii) গ্লুকোজ-৬-ফসফেট ফসফোগুকোআইসোমারেজ নামক এনজাইমের প্রভাবে ফ্রুক্টোজ—৬-ফসফেটে পরিণত হয় ।
গ্লুকোজ-৬-ফসফেট→ ফ্রুক্টোজ-৬-ফসফেট
(iii) ফ্রুক্টোজ-৬-ফসফেট ফসফোফ্রুক্টোকাইনেজ এনজাইম ও ATP-র উপস্থিতিতে ফ্রুক্টোজ-১, ৬-বিস ফসফেট যৌগ ও ADP তৈরি করে। উৎপন্ন যৌগটি ৬-কার্বন যুক্ত।
ফ্রুক্টোজ-৬-ফসফেট + ATP → ফ্রুক্টোজ-১, ৬-বিস ফসফেট + ADP
(iv) ফ্রুক্টোজ-১, ৬-বিস ফসফেট অ্যালডোলেজ এনজাইমের প্রভাবে ৩-ফসফোগ্লিসারালডিহাইড এবং ডাইহাইড্রক্সি-অ্যাসিটোন ফসফেটে রূপান্তরিত হয় ।
গ্লুকোজ-১, ৬-বিস ফসফেট→ ৩-ফসফোগ্লিসারৱ্যালডিহাইড + ডাই হাইড্রক্সি-অ্যাসিটোন ফসফেট।
৩-ফসফোগ্লিসারালডিহাইড থেকে গ্লাইকোলাইসিসের পরবর্তী বিক্রিয়া চলতে থাকে। এরপর ৩- ফসফোগ্লিসারালডিহাইড H3PO4 যারা ফসফরাসযুক্ত হয় এবং NAD+ দ্বারা জারিত হয়ে ১, ৩-বিস-ফসফোগ্লিসারিক এসিডে পরিণত হয়। বিক্রিয়াটি গ্লিসারালডিহাইড ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইম দ্বারা সম্পন্ন হয়।
৩.ফসফোগ্লিসার্যালডিহাইড+NAD + H3PO4→
১.৩-বিসফসফোগ্লিসারিক এসিড +NADH + H ডিহাইড্রোজিনেজ
(vi) ১, ৩-বিস-ফসফোগ্লিসারিক এসিড ফসফোগ্লিসারেট কাইনেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিডে পরিণত হয়। এই বিক্রিয়ায় ফসফরাস বিযুক্ত হয়ে ADP-র সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ATP গঠন করে।
১. ৩-বিস ফসফোগ্লিসারিক এসিড + ADP→ ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিড +ATP
(vii) ৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিড ফসফোগ্লিসারেট মিউটেজ নামক এনজাইমের সহায়তায় ২-ফসফোগ্লিসারিক এসিডে পরিণত হয়।
৩-ফসফোগ্লিসারিক এসিড→২- ফসফোগ্লিসারিক এসিড
(viii) ২-ফসফোগ্লিসারিক এসিড পরবর্তী পর্যায়ে ইনোলেজ এনজাইমের প্রভাবে এক অণু পানি ত্যাগ করে ২- ফসফোইনোল পাইরুভিক এসিড উৎপন্ন করে।
২-ফসফোগ্লিসারিক এসিড→২-ফসফোইনোল পাইরুভিক এসিড +H 2O
(ix) গ্লাইকোলাইসিসের শেষ পর্যায়ে পাইরুভেট কাইনেজ এনজাইমের প্রভাবে ২-ফসফোইনোল পাইরুভিক এসিড থেকে ফসফেট মুক্ত হয়ে ATP ও পাইরুভিক এসিড উৎপন্ন হয় ।
২-ফসফোইনোল পাইরুভিক এসিড + ADP→ পাইরুভিক এসিড + ATP
গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় প্রতি অণু গ্লুকোজ জারিত হয়ে ২ অণু পাইরুভিক এসিড উৎপন্ন করে। বিক্রিয়ার পর্যায়গুলোতে মোট ৪ অণু ATP উৎপন্ন হয় এবং ২ অণু ব্যয় হয় ফলে ৪-২ = ২ অণু ATP প্রকৃত (ncat) লাভ হয় । গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ার একটি ধাপে উৎপন্ন ২ অণু NADH, থেকে সবাত শ্বসনের ক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যায়ে ৩ অণু ATP পাওয়া যায়। গ্লাইকোলাইসিসের বিক্রিয়াগুলো কোষের সাইটোপ্লাজমে ঘটে থাকে।
গ্লাইকোলাইসিস-এর নিয়ন্ত্রণ
গ্লাইকোলাইসিস ত্বরান্বিত হয় ATP-এর ব্যবহার দ্রুত হলে, ATP-এর ব্যবহার হ্রাস পেলে প্রক্রিয়ার হার কমে যায়। গ্লুকোজ-এর প্রাপ্তি তথা সরবরাহের পরিমাণ এ প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
অ্যালোস্টেরিক এনজাইম ‘ফসফোফ্রুক্টোকাইনেজ' যা ফ্রুক্টোজ ১-ফসফেজ থেকে ফ্রুক্টোজ ১, ৬ বিসফসফেট তৈরি করতে সহায়তা করে, তার গতিময়তার উপর গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়া বহুলাংশে নির্ভরশীল। ATP দ্বারা এর কাজ বাধাগ্রস্ত হয় এবং ADP দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়।
গ্লাইকোলাইসিস-এর গুরুত্বঃ
১. গ্লাইকোলাইসিস হচ্ছে সকল জীবকোষে গ্লুকোজ জারণের একটি পর্যায় এবং বিক্রিয়াগুলো সকল জীবে একই রকম।
২. গ্লাইকোলাইসিসের ফলে উৎপন্ন দুই অণু পাইরুভিক এসিড ক্রেবস চক্রের সাবস্ট্রেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩. গ্লাইকোলাইসিসের গ্লুকোজ থেকে পাইরুভিক এসিড পর্যন্ত উৎপন্ন একাধিক অন্তর্বর্তী যৌগগুলো জীবের বিভিন্ন বিপাকীয় কাজে ব্যবহৃত হয়।
৪. গ্লাইকোলাইসিসের ফলে ৪ অণু ATP উৎপন্ন হয় এবং অবাত শ্বসনকারী জীবদের ক্ষেত্রে এখানে উৎপন্ন ২ অণু NADH, অন্যান্য বিপাকীয় কাজে ব্যবহৃত হয়।
পাইরুভিক এসিড থেকে উৎপাদিত ২-কার্বন বিশিষ্ট যৌগ অ্যাসিটাইল Co-A একটি জটিল চক্রের মাধ্যমে জারিত হয়ে CO2 এবং পানি প্রস্তুত করে। এ চক্রটির বিশদ বিবরণ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের প্রাণরসায়নবিদ স্যার হ্যানস ক্রেবস (Sir Hans Adolf Krebs, 1900 – 1981) প্রদান করেছিলেন । এজন্য তাঁর নামানুসারে এ চক্রকে ক্রেবস চক্র বলা হয়। এ চক্রের প্রথম উৎপাদিত যৌগ সাইট্রিক এসিড হওয়ায় ক্রেবস চক্রকে সাইট্রিক এসিড চক্র (Citric Acid Cycle)-ও বলে। সাইট্রিক এসিডে তিনটি কার্বক্সিল -COOH) গ্রুপ থাকায় একে বর্তমানে ট্রাই কার্বক্সিলিক এসিড চক্র বা টিসিএ চক্র (Tricarboxylic Acid Cycle বা TCA Cycle) বলে। ক্রেবস চক্রের সমগ্র বিক্রিয়াগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার মাতৃকার মধ্যে সম্পন্ন হয়। প্রকৃতপক্ষে, পাইরুভিক এসিডের সবাত জারণ (Aerobic Oxidation of Pyruvic Acid) ক্রেবস চক্রের মাধ্যমেই ঘটে
উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্রেবস চক্রের পার্থক্যঃ
১. উদ্ভিদে সাকসিনিল Co-A সিনথেটেজ ATP তৈরি করে কিন্তু প্রাণীতে GTP তৈরি হয়। GTP পরে একটি এনজাইম বিক্রিয়ার মাধ্যমে ATP-তে রূপান্তরিত হয়।
২. আজ পর্যন্ত পরীক্ষাকৃত সকল উদ্ভিদ মাইটোকন্ডিয়াতে NAD - malic enzyme পাওয়া গিয়াছে) এই এনজাইম ম্যালিক এসিড (ম্যালেট) কে পাইরুভিক এসিড-এ রূপান্তরিত করে যা অ্যাসিটাইল Co-A সৃষ্টির মাধ্যমে ক্রেবস চকে প্রবেশ করে। প্রাণীতে এরূপ বিক্রিয়া ঘটে না ।
ক্রেবস চক্রের গুরুত্বঃ
১. ক্রেবস চক্র শক্তি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র । শ্বসনে উৎপাদিত শক্তির অধিকাংশ এ চক্রের মাধ্যমে ঘটে ।
২. শর্করা, ফ্যাটি এসিড এবং অ্যামিনো এসিডের জারণের সাধারণ পথ হচ্ছে ক্রবস চক্র।
৩. ক্রেবস চক্রে প্রতি অণু গ্লুকোজের সম্পূর্ণ জারণে ২৪ অণু ATP উৎপন্ন হয়।
৪. ৫- কিটোগ্লটাকি এসিড ও অক্সালো অ্যাসেটিক এসিড N2 বিপাকের সাথে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করে।
৫. ক্রেবস চক্রে উৎপন্ন সাক্সিনিল Co-Aক্লোরোফিল, হিমোগ্লোবিন, সাইট্রোক্রোম প্রভৃতি যৌগ সংশ্লেষে অংশ গ্রহণ করে।
৬. ক্রেবস চক্রে উৎপন্ন অক্সালো অ্যাসেটিক এসিড পিরিমিডিন, অ্যালকালয়েড যৌগ তৈরিতে অংশ গ্রহণ করে।
৭. ক্রেবস চক্রে উৎপন্ন জৈব এসিডগুলো জৈব এসিড বিপাকে অংশগ্রহণ করে।
৮. আমরা শ্বসনে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করি তা এই চক্র থেকেই উৎপন্ন হয়।
গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস চক্রে যে সমস্ত জারণমূলক বিক্রিয়াগুলো ঘটে তাতে আণবিক O, এর প্রয়োজন হয় না। JAD ও FAD জারক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন অন্তর্বর্তী যৌগগুলোকে জারিত করে এবং বিক্রিয়াশেষে নিজেরা বিজারিত হয়ে NADH +H * ও FADH2 গঠন করে। বিজারিত এই কো-এনজাইমগুলো সবাত শ্বসনের শেষ পর্যায়ে মুক্ত অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে পানি (H2O) গঠন করে এবং নিজেরা জারিত হয়। কিন্তু NADH +H+ ও FADH, সরাসরি অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হতে পারে না। এই সংযোগ মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্ত:ঝিল্লি (inner membrane) - তে একটি ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সংঘটিত হয়। সবাত শ্বসনের শেষ পর্যায়ে মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্ত:ঝিল্লি বা ইনার মেমব্রেন-এ অবস্থিত বিভিন্ন ইলেক্ট্রন বাহকগুলো যে প্রক্রিয়ায় বিজারিত NAD ও FAD কে জারিত করে এবং আণবিক অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পানির অণু ও ATP সংশ্লেষ করে তাকে ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (Electron transport system) বা ইলেক্ট্রন পরিবহন তন্ত্র বলে।
আধুনিক ধারণা মতে মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্ত:ঝিল্লিতে ইলেক্ট্রন পরিবহন তন্ত্র পরিচালনা করার জন্য চারটি কমপ্লেক্স (complex) পৃথক পৃথক ভাবে কাজ করে। কমপ্লেক্সগুলো নিম্নরূপ
১. কমপ্লেক্স - I : এ কমপ্লেক্সে ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইম, FMN ও কয়েকটি আয়রণ-সালফার (Fe-S) কেন্দ্র থাকে। এ কমপ্লেক্সে NADH+H+ উপস্থিত হলে NADH ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইম দ্বারা জারিত হয়। এ সময় ইউবিকুইনোন (ubiquinone) বা কো-এনজাইম Q নামে একটি ইলেক্ট্রন বাহক থাকে যা ইলেক্ট্রনকে কমপ্লেক্স-I থেকে কমপ্লেক্স-II তে বহন করে । এখানে একটি ATP তৈরি হয়।
২. কমপ্লেক্স-II : এ কমপ্লেক্সে যুক্ত থাকে সাকসিনেট ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইম। এটি এক ধরনের ফ্ল্যাভো- প্রেটিন (flavoprotein) যার প্রস্থেটিক গ্রুপ হচ্ছে FAD (Flavin Adenine Dinucleotide) এবং নন হেমিন লৌহ। এ কমপ্লেক্সটি সাকসিনিক এসিড থেকে ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে (ক্রেবস চক্রে সাকসিনিক জারিত হয় ফিউমারিক এসিড উৎপন্নের সময়) কো-এনজাইম-Q এ স্থানান্তর করে ফলে ইউবিকুইনোন (Co-Q) বিজারিত হয়।
৩. কমপ্লেক্স -III : এ কমপ্লেক্স গঠিত হয় সাইটোক্রোম-b এবং সাইটোক্রোম-c নিয়ে। সাইটোক্রোম-b ধারণ করে নন হেমিন লৌহ। বিজারিত ইউবিকুইনোন থেকে ইলেক্ট্রন এ কমপ্লেক্সে আসায় ইউবিকুইনোন জারিত হয় এবং ইলেক্ট্রনকে সাইটোক্রোম- অণুতে স্থানান্তর করে। এখানে একটি ATP তৈরি হয়।
৪. কমপ্লেক্স - IV : এ কমপ্লেক্সে আছে সাইটোক্রোম- অক্সিডেজ, সাইটোক্রোম- এবং সাইটোক্রোম 3 । এখানে বিজারিত সাইটোক্রোম- সাইটোক্রোম অক্সিডেজ এনজাইম দ্বারা জারিত হয়। শ্বসনের শেষ ভাগে আণবিক অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই জারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় বলে একে প্রান্তীয় শ্বসন (terminal respiration) বলে শ্বসনের সময় গৃহীত অক্সিজেন এই প্রান্তীয় শ্বসনে ব্যবহৃত হয়। এখানেও একটি ATP তৈরি হয়।
বিজারিত সাইটোক্রোম- প্রান্তীয় শ্বসনে O2 কে ব্যবহার করে সাইটোক্রোম অক্সিডেজ এনজাইমের সাহায্যে জারিত হয়ে পানি উৎপন্ন করে। এখানে ২ অণু বিজারিত সাইটোক্রোম-c (2 Cyt-c Fe2+) দুটি ইলেক্ট্রন ত্যাগ করে পুনরায় জারিত সাইটোক্রোম- তে (2Cyt-cFe3+) পরিণত হয়। নির্গত ইলেক্ট্রনদুটি অক্সিজেন পরমাণু ও দুটি হাইড্রোজেন আয়নের (2H+) সঙ্গে যুক্ত হয়ে H2O গঠন করে।সাইটোক্রোম অণুগুলো লৌহ সমন্বিত ক্রোমোপ্রোটিন। সাইটোক্রোমে অবস্থিত জারিত লৌহ পরমাণু (Fermi) ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে বিজারিত লৌহ (Fe++) পরমাণুতে পরিণত হয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সাইটোক্রোম বিজারিত ও ATP জারিত হয়ে ইলেক্ট্রনের উচ্চ বিজারণ বিভব থেকে নিম্ন বিজারণ বিভবে পৌছায়। ইলেক্ট্রন স্থানান্তরের এই পথে কয়েকটি পর্যায়ে (Com. I, Com. III, Com. IV) নির্গত শক্তি দ্বারা ADP ও Pi যুক্ত হয়ে ATP গঠন করে। জারণ বিক্রিয়াপথে এই ভাবে ATP সংশ্লেষকে অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন বলে । প্রতি অণু NADH + H+ এবং FADH, এই পথে জারিত হওয়ার সময় যথাক্রমে ৩ অণু ও ২ অণু ATP উৎপন্ন করে। এ ভাবে বিজারিত কো-এনজাইমগুলো জারিত হয়ে পুনরায় ক্রেবস চক্রের বিক্রিয়ায় অংশ নেয় ।
ETS-এর ইলেকট্রন বাহক
১. ফ্লাভোপ্রোটিন : এটি দুধরনের, ফ্লাভিন মনোনিউক্লিওটাইড (FMN) ও ফ্লাভিন অ্যাডিনিন ডাইনিউক্লিওটাইড (FAD)। এদুটি বেশ লম্বা অণুবিশিষ্ট প্রোটিন যা একত্রে ফ্লাভোপ্রোটিন তৈরি করে।
কাজ :
ইলেকট্রন প্রবাহতন্ত্রের প্রথম ইলেকট্রন গ্রহীতা হিসেবে ভূমিকা নেয় ।
বিজারিত NAD+ বা NADP+ থেকে হাইড্রোজেন অপসারিত করে সাইটোক্রোমে যায়।
২. সাইট্রোক্রোম : এটি একধরনের প্রোটিন এনজাইম যেখানে একটি অপ্রোটিন হেমিন অংশে লৌহ (Fe) রয়েছে। এখানে কয়েক রকমের সাইট্রোক্রোম যথা : সাইট্রোকোম b, c, a, ও a3 পাওয়া যায়। এখানে অপ্রোটিন অংশ লোহার পরিবর্তে কপার (Cu++) থাকে।
কাজ : এ এনজাইমের হেমিন গ্রুপের Fe (লৌহ) উপাদান জারণ-বিজারণের মাধ্যমে Fe++ এবং Fe+++
৩. কো-এনজাইম-Q : এটি ইউবিকুইনোন নামেও পরিচিত। এটি রাসায়নিকভাবে ভিটামিন-K এবং ভিটামিন-E এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং ক্লোরোপ্লাস্টের প্লাস্টোকুইনোন এর মতো ।
তিনটি
একটি
দুইটি
চারটি
একটি ও না
অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে শ্বসনিক বস্তুর অসম্পূর্ণ জারণের ফলে সামাণ্য পরিমাণে শক্তি ও বিভিন্ন প্রকার জৈব যৌগ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি অবাত শ্বসন নামে পরিচিত।
অবাত শ্বসন প্রক্রিয়াটিকে দুভাগে ভাগ করা যায়; যথা-১. গ্লাইকোলাইসিস এবং ২. পাইরুভিক এসিডের অসম্পূর্ণ জারণ।
নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো ।
১. গ্লাইকোলাইসিস (যে প্রক্রিয়ায় এক অণু গ্লুকোজ কিছু নির্দিষ্ট এনজাইমের সাহায্যে (EPM পথে) পর্যায়ক্রমিক ধাপে জারিত হয়ে দুই অণু পাইরুভিক এসিডে পরিণত হয়, তাকে গ্লাইকোলাইসিস বলে। এ অধ্যায়টি সবাত শ্বসনের গ্লাইকোলাইসিসের মতোই যেখানে গ্লুকোজ অণু পাইরুভিক এসিডে পরিণত করে।
২. পাইরুভিক এসিডের অসম্পূর্ণ জারণ : গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পাইরুভিক এসিড অসম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে ইথাইল অ্যালকোহল কিংবা ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন হয়।
ক. ইথাইল অ্যালকোহল (ইথানল) সৃষ্টি : এটি দুই ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে কার্বোক্সিলেজ এনজাইমের কার্যকারিতায় পাইরুভিক এসিড এক অণু CO, বের করে দিয়ে অ্যাসিট্যান্ডিহাইড উৎপন্ন করে এবং দ্বিতীয় ধাপে অ্যালকোহল ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের কার্যকারিতায় অ্যাসিট্যান্ডিহাইড, NADH+H+ হতে দুটি হাইড্রোজেন গ্রহণ করে ইথানল (ইথাইল অ্যালকোহল) উৎপন্ন করে এবং NAD মুক্ত হয়ে যায়।
খ. ল্যাকটিক এসিড সৃষ্টি : এ প্রক্রিয়া প্রাণীর পেশিকোষে এবং কিছু ব্যাকটেরিয়ায় দেখা যায়। এতে পাইরুভিক এসিড গ্লাইকোলাইসিসে উৎপন্ন NADH2 থেকে হাইড্রোজেন গ্রহণ করে ল্যাকটিক এসিডে পরিণত হয়। প্রক্রিয়াটি ল্যাকটিক ডিহাইড্রোজিনেজ এনজাইমের সক্রিয়তায় পরিচালিত হয় এবং এতে কোনো CO, সৃষ্টি হয় না।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের সময় পেশিকোষে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন হয়, ফলে পেশি সাময়িকভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে গড়ে। এ অবস্থাকে পেশির ক্লান্তি বলে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে কোষ থেকে ল্যাকটিক এসিড নির্গত হয়ে যায়, ফলে পেশি পুনরায় সক্রিয় হয়।
অবাত শ্বসন ও ফার্মেন্টেশন এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা দূরহ। ফার্মেন্টেশন এক ধরনের অবাত শ্বসন। অবাত শ্বসনের রাসায়নিক বিক্রিয়া এনজাইমের সহায়তায় কোষের বাইরে কোন পুষ্টি দ্রবণে বা মাধ্যমে ঘটে তাই ফার্মেন্টেশন এ প্রক্রিয়া সাধারণত কতকগুলো ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীবে দেখা যায়।
ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার সমীকরণ নিম্নরূপ :
গ্লুকোজ → (জাইমেজ এনজাইম) 2C2H5OH + CO2 +(২১ কিলোক্যালরি শক্তি
শ্বসনিক বস্তুঃ
সুক্রোজ প্রথমে ভেঙ্গে গুকোজ ও ফ্রুক্টোজ হয়ে গ্লাইকোলাইসিস-এ প্রবেশ করে। গ্লুকোজ সরাসরি শ্বসনিক বস্তু হিসেবে কাজ করে। অন্যান্য মনোস্যাকারাইড প্রথমে গ্লুকোজে পরিণত হয়, পরে শ্বসনে প্রবেশ করে । স্টার্চ, গ্লাইকোজেন পালিমার প্রথমে ভেঙ্গে গ্লুকোজ সৃষ্টির মাধ্যমে শ্বসনিক বস্তু হিসেবে কাজ করে । ফ্যাট ভেঙ্গে গ্লিসারল এবং ফ্যাটি এসিড- এ পরিণত হয়। গ্লিসারল গ্লিসারেল্ডিহাইড-৩-ফসফেট হয়ে শ্বসনে অংশগ্রহণ করে, আর ফ্যাটি এসিড অ্যাসিটাইল Co- এ সৃষ্টির মাধ্যমে শ্বসন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। প্রোটিন ভেঙ্গে অ্যামিনো এসিড তৈরি হয়; এর কতক অ্যাসিটাইল Co-A সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করে, আর কতক সাইট্রিক এসিড চক্রে প্রবেশ করে ।
শ্বসনিক হার বা শ্বসনিক কোশেন্ট (Respiratory Quotient, R.Q) নির্দিষ্ট সময়ে শ্বসনের ফলে নির্গত CO2 - এর পরিমাণ এবং গৃহীত অক্সিজেনের পরিমাণের অনুপাতকে শ্বসনিক হার (সংক্ষেপে R.Q) বলে৷ শ্বসনিক হার নিম্নোক্ত সমীকরণের মাধ্যমে হিসেব করা হয় ।
শ্বসনিক হার (R.Q) = O2 গ্রহণের পরিমাণ/CO2 ত্যাগের পরিমাণ
শ্বসনের সময় তার শ্বসনিক বস্তু কি ছিলো তার উপর নির্ভর করে শ্বসনিক হার বিভিন্ন হয়। যেমন গ্লুকোজ জারণের সময় ৬ অণু অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং ৬ অণু CO2 পরিত্যাগ করে। সুতরাং গ্লুকোজের শ্বসন অনুপাত হবে :১
অবাত শ্বসন সম্পন্নকারী জীবাণুর অনেক প্রজাতি ও প্রকরণ বাছাই করে শিল্পক্ষেত্রে বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে আধুনিক জীবপ্রযুক্তির কল্যাণে ব্যবহার সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে অবাত শ্বসন ও ফার্মেন্টেশন সম্পর্কিত জীবের ব্যবহার নিচে আলোচনা করা হলো।
১. পাউরুটি শিল্পে (In Baking industries) : পাউরুটি তৈরির সময় ময়দার সাথে ঈস্ট মিশিয়ে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায় রেখে দিলে প্রথমে হাইড্রোলাইসিস এবং পরে অ্যালকোহলিক ফার্মেন্টেশন ঘটে। এর ফলে CO2 গ্যাস ময়দার দলার মধ্যে বুদবুদ সৃষ্টি করায় ময়দার দলা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এ অবস্থায় ফোলা ময়দার দলাগুলোকে চুল্লীতে গরম করা হয়। চুন্নীর তাপে COM-এর বুদবুদগুলো প্রসারিত হতে হতে ফেটে যায় এবং ময়দার দলাগুলো স্পঞ্জী পাউরুটিতে পরিণত হয়। উপজাত হিসেবে অ্যালকোহল উবে যায় ।
২. মদ শিল্পে (In Brewing industries) : অবাত শ্বসনে ঈস্ট ব্যবহার করে আঙ্গুর, আপেল প্রভৃতি ফল থেকে মদ তৈরি করা হয় । তালের রস, খেজুরের রস, চিটাগুড় থেকেও অ্যালকোহল ও দেশী মদ তৈরি করা হয়।
৩. দুগ্ধ শিল্পে : দুই হচ্ছে ফার্মেন্টকৃত দুগ্ধজাত পদার্থ। ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় নাকটিক এসিড) ব্যাকটেরিয়া ৩-৫ ঘন্টার মধ্যে ৩৭-৩৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দুধকে দই-য়ে পরিণত করে। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার অংশগ্রহণে এক জটিল প্রক্রিয়ায় পনির (cheese) উৎপাদিত হয়। MAT দই ও পনির ছাড়াও বিভিন্ন দেশে অণুজীবের ফার্মেন্টেশনকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য উপাদান তৈরি করা হয়, যেমন-দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় কেফির (kefir), স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় তিত্তি (tactte), তুরস্কে তারহানা (tarhana) প্রভৃতি।
৪. ওষুধ শিল্পে : ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন করা হয়। পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্সিন ইত্যাদি অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন ছত্রাক ও অ্যাকটিনোমাইসিটিস-এর ফার্মেন্টেশন ক্রিয়ায় উৎপন্ন করা হয়।
৫. ভিনিগার উৎপাদন : গুড়ের মধ্যে ঈস্ট মিশিয়ে ইথাইল অ্যালকোহল উৎপন্ন হয়। এতে অ্যাসিটোব্যাক্টর অ্যাসেট Acetobacter aceti নামক ব্যাকটেরিয়ার জারণ ক্রিয়ায় অ্যাসেটিক এসিড বা ভিনিগার (সিরকা) উৎপন্ন করা হয়।
৬. চা ও তামাক শিল্পে : Bacillus megatherium নামক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে চা ও তামাক গাছের পাতাকে সুগন্ধ ও রুচিকর করা হয়।
৭. বিউটাইল অ্যালকোহল ও অ্যাসিটোন উৎপাদন : গুড়ে Clostridium acetobutylium ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ফার্মেন্টেশন ক্রিয়া চালানোর ফলে বিউটাইল অ্যালকোহল ও অ্যাসিটোন উৎপন্ন হয়।
৮. পাটের তন্তু নিষ্কাশনে Clostridium buyricum নামক ব্যাকটেরিয়ার ফার্মেন্টেশন ক্রিয়ায় পাটের তন্তু নিষ্কাশন করা হয়।
৯. চর্ম শিল্পে : চামড়া শিল্পে চামড়া থেকে পশুর লোম উঠিয়ে ফেলার জন্য এবং চর্বি ও অন্যান্য টিস্যু আলাদা করার জন্য বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যাকটেরিয়ার ফার্মেন্টেশনের ফলে চামড়া থেকে লোম, মেদটিস্যু ইত্যাদির অপসারণ ঘটে। যথা- Bacillus subtitis ।
এগুলো ছাড়াও ল্যাকটিক এসিড, অ্যামিনো এসিড ও বিভিন্ন এনজাইম উৎপাদনে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতিকে প্রয়োগ করা হয়।
শ্বসন একটি জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া। অন্যান্য জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার মতো এ প্রক্রিয়াও কিছু বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাবকে নিয়ন্ত্রিত হয় ।
ক. বহিঃপ্রভাবকসমূহ (External factors)
১. অক্সিজেনের ঘনত্ব : অক্সিজেনের ঘনত্ব সবাত শ্বসনকে প্রভাবান্বিত করে। অক্সিজেনের ঘনত্ব ৫%-১০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি শ্বসনের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ে। কিন্তু ৫% এর পূর্ব পর্যন্ত অক্সিজেনের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে শ্বসনের হারের কোন “উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না।
২. তাপমাত্রা : ০°-৪৫° সেল. পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শ্বসনের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ে। ৪৫° সেল. এর উর্ধ্ব তাপমাত্রায় শ্বসনের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে শ্বসন বন্ধ হয়ে যায়।
৩. কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব : শ্বসনিক বস্তুর চতুর্দিকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বাড়লে শ্বসনের হার কমে যায় ।
৪. আলো : শ্বসনের উপর আলোর প্রভাব পরোক্ষ। কম তীব্র আলো অপেক্ষা অধিক তীব্র আলোতে স্টোমাটা বেশি খোলা থাকে । ফলে, অধিক অক্সিজেন প্রবেশ করায় শ্বসনের হার বেশি হয়। আলো সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে শ্বসনিক বস্তু তৈরি করেও শ্বসনকে প্রভাবন্বিত করে।
৫. পানি পানি শ্বসনকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। পানি-সম্পৃক্ত প্রোটোপ্লাজমে শ্বসন অতি দ্রুত চলে। শ্বসনে জড়িত এনজাইমগুলোর সক্রিয়তার জন্যও পানির প্রয়োজন হয়।
খ. অন্তঃপ্রভাবকসমূহ (Internal factors)
৬. শ্বসনিক বস্তুর পরিমাণ ও প্রকৃতি : অন্যান্য অবস্থা অনুকূল থাকলে শ্বসনিক বস্তুর পরিমাণ বাড়ালে শ্বসনের হার বৃদ্ধি পায়। শ্বসনিক বস্তুর প্রকৃতির উপর শ্বসনের হার নির্ভরশীল।
৭. কোষের বয়স : কোষের বয়সের উপর শ্বসনের হার অনেকটা নির্ভরশীল। পরিণত কোষ অপেক্ষা অপরিণত কোষে সাধারণত বেশি প্রোটোপ্লাজম থাকে। এজন্য ভাজক কোষে শ্বসনের হার অধিক পরিলক্ষিত হয়।
৮. এনজাইম : শ্বসনক্রিয়া সম্পন্নের জন্য বিশেষ কতকগুলো এনজাইমের প্রয়োজন হয়। এসব এনজাইমের যে কোন একটির অভাবে শ্বসন ক্রিয়া বন্ধ থাকে। এনজাইমগুলোর পরিমাণের তারতম্যে শ্বসনের হারেরও তারতম্য হয়।